মুক্তচিন্তার সমস্যা
Wednesday, August 20, 2008
সম্প্রতি আমারব্লগ.কম এ ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে এই পোস্ট লিখছি।
ধর্মের সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে?-এই সাধারণ প্রশ্নটি নিয়ে যদি আলোচনা শুরু করি তাহলে ইতিহাসের চাকা অনেক পিছনে নিয়ে যেতে হয়। আগুন আবিষ্কার বা চাকা আবিষ্কার মানুষের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। প্রায় ১ লক্ষ বৎসর পূর্বে মানুষ আগুন আবিষ্কার করে। এর পর পশুত্ব থেকেই মানুষের মনুষত্বে উত্তরণের যাত্রা শুরু হয়েছে। পরবর্তী সহস্য বৎসরে মানুষের জীবন, আচরণ চিন্তাভাবনায় লেগেছে ব্যাপক পরিবর্তনের হাওয়া। ৪০-৬০ হাজার বৎসর পূর্বের নিয়ান্ডারথাল মানুষরাই প্রথম প্রশ্ন করে মানুষ মারা যায় কেন, বা জন্ম হয় কেন? সে সময়ে তারা এই সব কারণের পিছনে কোন মহাশক্তিধর কারও প্রভাবে কথা প্রথম কল্পনা করে। কিন্তু তারপরও ধর্ম কোন কাঠামোবদ্ধ রূপ পায় নাই। মানুষ তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির কার্যকারণ জানত না। নদী কেন প্রবহমান?- এই সহজ সত্যটাও তারা জানতো না। শুধু জানত নদীর পানি সতত বয়ে চলেছে একমুখে। তারা ভাবত হয়ত নদীর প্রাণ আছে। বিশালাকার পাহাড়, বটবৃক্ষ ইত্যাদির অতিকায় রূপের সামনে মানুষ নিজেকে হীন ভাবতে বাধ্য ছিল। তাকে জয় করবার বাসনা বা চেষ্টা যে করেনি তা কিন্তু নয়। অবশ্যই তারা প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে বন্যপশুর মত বশ করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু না পেরে তার উপর আরোপ করেছে দেবত্ববাদ। আগুনের ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করেছে। মেঘের চলাচল মানুষকে বিমুগ্ধ করার বদলে বরং আতংকিত করেছে। সূর্যগ্রহণ দেখে মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে পড়েছে। তারা তৎকালীন স্বল্পবুদ্ধিতে যা ভেবেছে, তাকেই অবশ্যমান্য বলে মনে করেছে। এভাবেই জন্ম নিয়েছে এনিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদ। অর্থাৎ তারা সবকিছুকে শক্তিমান ভেবেছে। সবকিছুতে তারা দেবত্ব আরোপ করেছে। এই ধরণের ধর্মকে বলে প্রিমিটিভ ধর্ম। আদিম ধর্মের এই সহজকাঠামো থেকে মানুষ পরবর্তী ধাপে পৌছেছে কৃষিকাজ আবিষ্কারের সময়ে। কৃষিকাজ আবিষ্কৃত হয়েছে ৫- ১৫ হাজার বৎসর আগে। মতান্তরে ৭-১০ হাজার। এই সময়ে মানুষের প্রাত্যাহিক খাদ্য চিন্তা অনেকটা দূর হয়ে গেছে। সাংবাৎসরিক খাবার ঘরে জমা থাকার কারণে ধর্ম বা জীবন সম্পর্কে ব্যাপক ভাবনাচিন্তার সময় তারা পেয়েছে। পূর্বের সমাজ ছিল সাম্যবাদী সমাজ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকার সময়ে মানুষ জন্ম দেয় দাসতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। অর্থাৎ যার গায়ের জোর বেশি ছিল, সে অন্যদেরকে মারামারিতে হারিয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে বসেছে গোত্রপতি। সে আর খাদ্য উৎপাদন করত না। অন্যের উৎপাদিত খাদ্যের উপরে ভাগ বসাত। বসে বসে শাসন করত। আর এই শাসনের প্রয়োজনে সে জন্ম দিল কিছু পুরোহিত শ্রেণীর। এরা ধর্মকে বিভিন্নভাবে মডারেশন করে আরও জটিল করে তোলে। দেখা গেছে ধর্মের একটা অন্যতম বিষয় হল শাসকের পক্ষে থাকা। এই কৃষিজীবী সময়েই শাসকের পক্ষে ধর্ম তার ভূমিকা পালন করা শুরু করে। পরবর্তী কয়েকহাজার বৎসরব্যাপী ধর্ম নিয়ে একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। একেশ্বরবাদ শুধু যীশু বা মোহাম্মদের আবিষ্কার নয়। এর আগেও মিশরের কয়েকজন ফারাও একেশ্বরবাদ নিয়ে বিভিন্নরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশের সাথে সাথে বহুঈশ্বরবাদকে হটিয়ে একেশ্বরবাদ বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
ব্রিটিশদের একটা নিয়ম ছিল ডিভাইড এন্ড রুল। এটা কিন্তু বৃটিশদের আবিষ্কার নয়। এটা ধর্মগুলো অনেক আগে থেকেই করে এসেছে। এবং এখনও করে চলেছে। মানুষের মধ্যে বিভিন্নরকম দলাদলি , মারামারি সৃষ্টি করেছে ধর্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে বেশি মানুষ খুন করেছে ধর্ম।
আরিফুর নামে জনৈক ব্লগারের প্রতি অন্যান্যদের আচরণ দেখে বোঝা যায় যে ধর্ম তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সমকালীন বাস্তব পৃথিবীতে ধর্ম তার উপযোগিতা হারিয়েছে। তবে ধর্মের সত্যতা নিয়ে সংশয় আধুনিক কিছু নয়। প্রাচীনকালেও একাধিক ব্যক্তি ছিল যারা ধর্মের সত্যতাতে সন্দেহ করতেন। আমাদের ভূমিখন্ডে (ভারতবর্ষ) চার্বাক নামে একটি সম্প্রদায় ছিল যারা ছিলেন সরাসরি ধর্মবিরোধী। হয়ত অনেকেই জানেন বৌদ্ধরাও কিন্তু আদতে ধর্মবিরোধী। তারা পরকাল, ঈশ্বর, স্বর্গ, বেহেশত, দোজখ কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না।
তাহলে এখন ধর্মের স্থান কোথায় এই সহজ প্রশ্নকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে যে ধর্মগুলোর প্রধানতম প্রবণতা হল মানুষকে অবিশ্বাস। মানুষকে বিভিন্নভাবে ছোট করে, অপমান করে ধর্ম তার নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। সমকালে এসে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে এই অপমান আমরা মেনে নিব কি না। কারণ সৎ থাকার জন্য মানুষের কোনরকম অজুহাত বা ভীতির দরকার নেই। যে কোন সময়ে আইন কানুন না থাকলে আপনি আমি কি অপরাধ শুরু করে দিব? না মোটেও না। ১/১১ এর পরবর্তী এক সপ্তাহের কথা ভাবুন। সে সময়ে আইন কানুন স্থবির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। মানুষ নিজ বুদ্ধি মেধা মানবিকতা ইত্যাদি দিয়েই সুস্থ সমাজ তৈরি করতে পারে। এর জন্য ধর্মের হুমকির দরকার পরে না। ফলে আধুনিক, বিবেকবান, বুদ্ধিমান, মানবিক, সৎ মানুষদের কাছে ধর্ম তার উপযোগীতা হারিয়ে ফেলেছে।
(আমি হয়ত অনেক কথা এলোমেলোভাবে বলে গেলাম। ব্লগিং এ নতুন বলে এরকমটা হতে পারে, তবে আমার বক্তব্যের মূল সুরটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন।)
ধন্যবাদ সকলকে
প্রথম প্রকাশ: আমারব্লগ.কম
0 comments:
Post a Comment