পরহিংসায় আপন ক্ষয়

Friday, January 9, 2009

কয়েকদিন আগে ইসরাইল প্যালেস্টাইনে আক্রমণ করেছে। সেখানকার হামাস নামক সন্ত্রাসীরা নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার জন্য দায়ী এই অভিযোগ করা হয়েছে ইসরাইলের পক্ষ থেকে। আমি যে কোন রকমের যুদ্ধ বা হানাহানির বিপক্ষে। সেই পুরাতন কবিতাটিকে খুব মানি:-

কুকুরের কাজ কুকুর করেছে,
কামড় দিয়েছে পায়,
তাই বলে কি কুকুরকে কামড়ানো
মানুষের শোভা পায়?
না পায় না। কুকুরের মতো করে মানুষ যদি কুকুরের গায়ে কামড়ায়, তাহলে তো সে আর মানুষ থাকলো না। সে তো কুকুরের মতো আচরণ করলো। একথা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে কি কুকুরের গায়ে লাত্থিটাও দেবে না। কামড়াতে আসা কুকুরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে নিজেকে বাঁচাবে না? কিংবা কামড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া কুকুরকে খুঁজে নিয়ে লাঠি দিয়ে পেটাবে না? অবশ্যই পেটাবে। সেজন্যই তো মানুষখেকো বাঘকে সরকারিভাবে শিকারী দিয়ে খুঁজে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাঘ মানুষকে মেরে খেয়ে ফেলেছে, সে জন্য তো আর মানুষ বাঘকে মেরে ফেলে খেয়ে ফেলছে না।

এত কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম। ইসরাইল যে ফিলিস্তিনীদের উপর হামলা চালাচ্ছে, এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখের কোন সীমা নেই। ব্লগে ব্লগে এর নিন্দায় তারা বুক-পেট ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ ইতিহাসকে স্মরণ করছেন না। আজকে যে জেরুজালেম নিয়ে ইসরাইল তথা ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছে, তাকে অনেকে নানা দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেন। তার মধ্যে কেউ একে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, আবার কেউ বা শুধুমাত্র ভূমিদস্যূতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখেন। আমরা দুটোকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। ইতিহাসে ইহুদী ও মুসলমানদের পরস্পরের যে ভূমিকা তা স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরানে ইহুদীদের সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় নোংরাভাবে গালাগালি করা হয়েছে। ইহুদী জাতি ও তাদের ধর্ম সম্পর্কে অশ্লীল, কুৎসিত, জঘন্য রকমের মন্তব্য করা হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরানে। বিপরীতে কিন্তু মুসলমানদের সম্পর্কে ইহুদীরা কোথাও কোন খারাপ কথা লেখেনি।
আজকে যে আল আকসা মসজিদ নিয়ে মুসলমানদের খুব দরদ উছলে পড়ছে তার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, অতীতে মুসলমানরা সবাই এই মসজিদের দিকে তাকিয়ে নামাজ পড়তো। হঠাৎ একদিন নামাজ চলাকালীন মুহাম্মদ দাড়িয়ে উঠে বললেন যে এইমাত্র তার কাছে ওহী এসেছে যে এখন থেকে তার জন্মস্থানের দিকে (কাবাঘর) তাকিয়ে নামাজ পড়তে হবে। এইযে হিংসামো বা পরহিংসার প্রকাশ এটা কে করলো? ইহুদীরা তো করতে যায়নি।

মুসলমানদের একটা কমন অভিযোগ হলো যে ইহুদীরা মুসলমানদের প্রতি নবীর আমল থেকে খারাপ ব্যবহার করতো। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে যে কেন তারা এমন করেছিল। মুহাম্মদই কি প্রথম ইহুদীদের ধর্ম সম্পর্কে আজেবাজে গালিগালাজ প্রচার করা শুরু করেনি? মুহম্মদই কি প্রথমে ইহুদীদের ধর্মকে বাতিল, টাতিল ইত্যাদি কুৎসিত গালিগালাজ করা শুরু করেনি? কেউ যদি আপনাকে গালি দেয়, তাকে হয়তো দু'একদিন আপনি উপেক্ষা করতে পারেন। কিন্তু সেই গালিগালাজকেই যদি সে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে, যদি প্রতিদিনি যদি আপনার আসা যাওয়ার রাস্তার পাশে দাড়িয়ে বা আপনার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে যদি আপনাকেই গালিগালাজ করতে থাকে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয় আপনিও এর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবেন। ঠিক সেই কাজটিই করেছিল ইহুদীরা। অথচ তাদেরকে কেন অযথা দোষ দেয়া? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আজকের মুসলমানরা তাদের কোরান থেকে ইহুদীদের সম্পর্কে অশ্লীল, কুৎসিত, নোংরা, জঘন্য বাক্যগুলো ঘৃণার সাথে বাতিল করে দিক, তারা ঘোষণা করুক যে ইহুদীদের সম্পর্কে কোরানে যেসব আজেবাজে কথা আছে, তার জন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থী, তার জন্য তারা লজ্জিত, তাহলে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে মুহূর্তমাত্র দেরী হবে না। তারা কোরান থেকে ঐসব বাজে কথাগুলি মুছে ফেলুক, ইহুদীরা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে।
আমার কাছে বরং মুসলমানদের চাইতে ইহুদীদেরকেই বেশি উদার মনে হয়। তাদের ধর্মকেই বরং অধিকতর ভদ্র বলে মনে হয়। তার একটা সহজ প্রমাণ হল পাকিস্তানের ইমরান খানের স্ত্রী জেমিমা খান। জেমিমা খান ইহুদী পরিবারের মেয়ে, তার সঙ্গে মুসলমান ইমরান খানের বিয়ে দিতে তার বাবা-মা গররাজি হয় নাই। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কি এমন দেখা যাবে? কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান বাবা-মা কি ইহুদী ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবে? না হবে না। তাহলে কি হলো? কি বোঝা গেল?

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অভিযোগ তোলা হয়। আমার প্রশ্ন হলো আরব ভূমিতে ইহুদীদের নিজস্ব কোন দেশ নেই কেন? আরবের অন্য কোন দেশে ইহুদীরা নেই কেন? এর কারণ কি? একথা সবাই জানে যে, গত কয়েকশত বৎসরে আরব ভূমি থেকে ইহুদীদের উপর অবর্ননীয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদেরকে জানে মালে মেরে ফেলা হয়েছে। এই ভয়ংকর আক্রমণের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে আরব অঞ্চলে ইহুদীরা টিকে থাকতে পারেনি। তারা বাধ্য হয়েছে দেশত্যাগ করতে। মুসলমানদের অব্যাহত আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তারা সঠিকভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি। (আজ ফিলিস্তিনীরা দুর্বল, তখন ইহুদীরা দুর্বল ছিল)। ফলে ইহুদীরা প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। হয়ে পড়েছিল না ঘরকা, না ঘাটকা। জীবিকার খাতিরে তাদেরকে কত নিম্নমানের কাজই না করতে হয়েছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত অন্য ব্যক্তিবর্গের নিন্দা-ঘৃণা সহ্য করে তাদেরকে বেচেবর্তে থাকতে হয়েছিল (শেক্সপিয়রের শাইলক দ্রষ্টব্য)। ইউরোপে তাদেরকে যত সুদখোর, লোভী বলে গালিগালাজ করা হোক না কেন, অন্তত প্রাণে মেরে ফেলা হয়নি। শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচার আশায় তারা ইউরোপীয়দের গালিগালাজকে মেনে নিয়েছিল। পরবর্তীতে তারা যখন অর্থে বিত্তে, রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞানে মেধার স্বাক্ষর রাখা শুরু করলো, নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে শুরু করলো। অর্থাৎ আত্মসম্মান পাবার জন্য যথেষ্ট শক্তিমত্তা অর্জন করতে পারলো, তখন তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি নিজস্ব ইহুদী ভূখণ্ড পেতে চাইলো। লক্ষ্য করুন। তারা কিন্তু খ্রিস্টান যিশুকে মেরে ফেলেছিল। আর সেই খ্রিস্টানদের সহযোগিতাতেই তারা ফিরে পেল একটি নিজস্ব ভূখণ্ড। দুই হাজার বছর আগে যা ছিল আসলে তাদের নিজস্ব দেশ। যা আসলে তারা মুসলমানদের হিংস্র আক্রমণের মুখে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।

কয়েকশত বৎসর ধরে তাদের উপর যে অত্যাচার করা হয়েছিল, তার কোন শোধ কি তারা নিতে চাইবে না? আমি ইহুদীদের উপরে মুসলমানদের অত্যাচার বা বিপরীতে মুসলমানদের উপর ইহুদী অত্যাচারের বিরোধী। কিন্তু যদি ইহুদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি, তাহলে কি বলা যায় না যে তারা ইতিহাসের প্রতিশোধ নিচ্ছেন? কুকুরের কামড়ের জবাবে লাত্থি দিচ্ছেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, যারা বাংলাদেশের হিন্দুদের উপরে মুসলমানদের অত্যাচারকে ভূমিদস্যুতা বলে হালকা করতে চান, তারা ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের উপর আক্রমণকেও একই দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করুন।

0 comments:

Post a Comment

Blog Archive

মুক্তমনা বাংলা ব্লগ

  © Dristipat

Back to TOP