মুসলিম দেশের ভাস্কর্য
Friday, October 31, 2008
আজকের সমকাল পত্রিকায় মুসলিম দেশের যত ভাস্কর্য নামে একটি রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এই রচনায় মুসলিমদেশগুলোতেও যে মানুষের মূর্তি বা ভাস্কর্য রয়েছে এই বিষয়ে বলা হয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলো বিষয়ে সেইসব দেশের মুসলিম নেতারা যে কোন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখান না সেই কথাটাই রচনার মূল বিষয়।
রচনাটি সম্পূর্ণ নিম্নরূপ। লিখেছেন: আজাদুর রহমান চন্দন।
সম্প্রতি এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল বাংলাদেশে। একদল (মাত্র শ’ দেড়েক) সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থির আপত্তির মুখে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ‘অচিন পাখি’ নামের নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভেঙে সরিয়ে ফেলেছে সরকার। এ নিয়ে সঙ্গত কারণেই গত দু’সপ্তাহ ধরে দেশের নানা স্থানে নিন্দা-প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন অসাম্প্রদায়িক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি হুঙ্কার ছাড়ছে- তারা ক্ষমতায় গেলে নাকি দেশের সব ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার ভেঙে ফেলবে; নিভিয়ে দেবে ‘শিখা চিরন্তন’ ও ‘শিখা অনির্বাণ’।সমস্ত লেখাটি পড়লে বোঝা যায় লেখকের একপেশে মনোভঙ্গির কারণে কিছুটা একপাক্ষিক হয়ে গেছে। পূর্ববর্তী উদাহরণগুলোর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ যতটুকু রয়েছে, তার তুলনায় ধর্মীয় কারণ রয়েছে ঠিক ততোটাই অনুপস্থিত।
বাংলাদেশে স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী এ চত্রক্রটি বরাবরই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে আসছে। অথচ স্থাপত্য-ভাস্কর্য এসবের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ দেখা যায় না বাস্তবে; বরং দেশে দেশে স্থাপত্য-ভাস্কর্য নির্মাণে মুসলমানদের অবদানও রয়েছে যথেষ্ট। এ উপমহাদেশের অধিকাংশ খ্যাতনামা স্থাপত্যই মুসলমান শাসকদের সৃষ্টি। শুধু তা-ই নয়, ইরান, ইরাক, মিসর, সিরিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিরা যখন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে, তখন ইরানের পার্লামেন্ট তার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।ইরানে কবি ফেরদৌসী তুসীর ভাস্কর্য
যে যুক্তি দিয়ে এ দেশের মৌলবাদীরা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে, সে যুক্তিতে কিন্তু মানুষের ছবি তোলাটাও ঠিক নয়। অথচ বাস্তবে ওই মৌলবাদীরাও ছবি তুলছেন নিজের স্বার্থে। এমনকি কট্টর রক্ষণশীল মুসলিম দেশ সৌদি আরবে খেলনা পুতুল বিক্রি হয় বৈধভাবেই। ওই পুতুল সে দেশে খুবই জনপ্রিয়।
ইরান, মিসর, ইরাকের জাদুঘরে অসংখ্য ভাস্কর্য এবং প্রাচীন শাসক ও দেব-দেবীর মূর্তি তো রয়েছেই, সেসব দেশে উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতাস্তম্ভ, যার নাম ‘আজাদী’। এ স্থাপত্যটির ডিজাইনার হোসেন আমানত একজন মুসলমান। কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহ্র মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। মাশহাদ নগরীতে ভাস্কর্যসংবলিত নাদির শাহ্র সমাধিসৌধটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
ইরানের রাজধানী তেহরানে দু’বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয় সমকালীন ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা। সর্বশেষ ও পঞ্চম দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীটি হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এতে ১০৫ জন শিল্কপ্পীর ১১২টি ভাস্কর্য ঠাঁই পায়। তেহরান মিউজিয়াম অব কনটেম্পরারি আর্টসে আয়োজিত এ প্রদর্শনী স্পন্সর করে সে দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
ইরানের মাজানদারান প্রদেশে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় বালির তৈরি ভাস্কর্য প্রদর্শনীর। এটি একটি উৎসব- স্যান্ড স্কাল্পচার ফেষ্টিভ্যাল। ২০০৫ সালের ১ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর মাজানদারান প্রদেশের বাবলসার নগরীতে অনুষ্ঠিত হয় বালির তৈরি ভাস্কর্যের প্রথম প্রদর্শনী। দ্বিতীয়বার হয় ২০০৬ সালের ৬ থেকে ২১ আগষ্ট বাবলসার, সারি ও রামসার নগরীতে। এতে ২৭৫টি ভাস্কর্য ঠাঁই পায়। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাজানদারান প্রদেশে বালির তৈরি ভাস্কর্যের সপ্তাহব্যাপী তৃতীয় জাতীয় প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রভিন্সিয়াল কালচার অ্যান্ড ইসলামিক গাইডেন্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায়।
পিরামিডের জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি মিসরের। বিরাটত্বের দিক থেকে বিখ্যাত হলো জোসার বা স্টেপ (সোপান) পিরামিড ও গিজা পিরামিড। পাথরের তৈরি স্ফিংসের মূর্তিসংবলিত গিজা পিরামিড সারা দুনিয়ার পর্যটকদের অতি প্রিয়। শুধু ইসলামপূর্বই নয়, অনেক অনেককাল আগের তথা খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার অব্দের এসব মূর্তি মিসরের মুসলমানরা ধ্বংস করেনি, গর্বের সঙ্গে রক্ষা করে। সম্প্রতি আফগানিস্তানে যে তালেবানরা বামিয়ানের জগদ্বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছে তারা মৌলবাদী, বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে তাদের মিল নেই। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘মিসরের রেনেসাঁ’।
ইরাকেও আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। বাগদাদের পাশে আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সাদ্দাম হোসেনের বিশাল আকারের ভাস্কর্যটি মার্কিন আগ্রাসনের পর ভেঙে ফেলে সাদ্দামের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা মার্কিন বাহিনীর মদদপুষ্ট। এটা ভাঙা হয় রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে নয়।
সমকাল, ৩১ অক্টোবর, ২০০৮
0 comments:
Post a Comment